Logo
শিরোনাম
ডাক্তার হওয়ার বদলে যেভাবে গীতিকার হয়ে উঠেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার
ক্রাইম ভিশন

প্রকাশ: 04 Sep 2025 | 09:25am | আপডেট: 04 Sep 2025 | 09:25am

ডাক্তার হওয়ার বদলে যেভাবে গীতিকার হয়ে উঠেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার

বিনোদন ডেস্ক:

একটা সময় ছিল, যখন মানুষ গান শোনার জন্য রেডিওর সামনে অপেক্ষা করত। তখন দেশে টেলিভিশনও ছিল মাত্র একটি। আর সেসব সময়ে, ভোর-বিকেল-রাত মিলিয়ে বারবার বাজত যেসব গান-তার অনেকগুলোর স্রষ্টা ছিলেন গাজী মাজহারুল আনোয়ার।

বাংলাদেশের অসংখ্য কালজয়ী গান, বিশেষ করে দেশাত্মবোধক সংগীতের আঙিনায় যে নামটি চিরকাল দীপ্ত হয়ে থাকবে, তিনি গাজী মাজহারুল আনোয়ার। আজ তাঁর তৃতীয় মৃত্যুবার্ষিকীতে তাঁকে স্মরণ করছে পুরো দেশ।

ষাটের দশকের শুরুর কথা। তিনি তখন মেডিকেল কলেজে ভর্তি হয়েছেন। ডাক্তার হবেন, এটাই ছিল পরিবারের স্বপ্ন। কিন্তু ভেতরে ভেতরে কবিতা লিখতেন নিয়মিত। কুমিল্লায় স্কুলজীবন থেকেই দেয়ালপত্রিকায় তাঁর কবিতা ছাপা হতো।

একদিন কলেজ নাটকের জন্য একটি গানের দরকার হলো। প্রথমে দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আবু হেনা মোস্তফা কামালকে, কিন্তু সময়াভাবে তিনি লিখতে পারলেন না। তখন সাহস করে এগিয়ে এলেন তরুণ গাজী মাজহারুল আনোয়ার। লিখলেন তাঁর জীবনের প্রথম গান। সেটিই হয়ে উঠল তাঁর গীতিকার জীবনের হাতেখড়ি।

পরে একদিন ফরিদা ইয়াসমিন সেই গান রেডিওতে গাওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন। যদিও আনুষ্ঠানিকভাবে তাঁর নাম যায়নি, তবে মনের ভেতরে দৃঢ় বিশ্বাস জন্ম নিল-‘গান আমি লিখতে পারি, আর এ পথেই হয়তো আমার ভাগ্য লুকিয়ে আছে।’ সেখান থেকেই শুরু হলো অদম্য পথচলা।

প্রথম গান লেখার পর তাঁর পথ চলা ছিল দারুণ সৃষ্টিশীল। শুরুর পরবর্তী পাঁচ দশক ধরে তিনি লিখেছেন ২০ হাজারেরও বেশি গান। দেশপ্রেম, মুক্তিযুদ্ধ, ভালোবাসা, মানুষের সুখ-দুঃখ-সবই উঠে এসেছে তাঁর কলমে।

‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘একতারা তুই দেশের কথা বল রে এবার বল’, ‘এক নদী রক্ত পেরিয়ে’, ‘আকাশের হাতে আছে একরাশ নীল’-এসব গান আজও বাঙালির হৃদয়ের স্পন্দন।

২০০৬ সালে বিবিসি বাংলার জরিপে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ বাংলা গানের তালিকায় তাঁর তিনটি গান জায়গা করে নেয়-

‘জয় বাংলা বাংলার জয়’, ‘একবার যেতে দে না আমার ছোট্ট সোনার গাঁয়ে’ এবং ‘একতারা তুই দেশের কথা বল’।

বাংলাদেশের শীর্ষ কণ্ঠশিল্পীদের ক্যারিয়ারও উজ্জ্বল হয়েছে তাঁর লেখা গান দিয়ে। শাহনাজ রহমতউল্লাহ, রুনা লায়লা, সৈয়দ আব্দুল হাদি, সাবিনা ইয়াসমিন-সবাই গেয়েছেন তাঁর সৃষ্টি। রুনা লায়লার চলচ্চিত্রে অভিষেকও হয়েছিল তাঁর লেখা গান ‘গানেরই খাতায় স্বরলিপি লিখে’ দিয়ে। আর সাবিনা ইয়াসমিনের কাছে তাঁর লেখা ‘যদি আমাকে জানতে সাধ হয়’ গানটি রয়ে গেছে হৃদয়ের সবচেয়ে কাছের স্মৃতি হয়ে।

শুধু গীতিকার নন, তিনি ছিলেন সফল চলচ্চিত্র পরিচালক ও প্রযোজকও। পরিচালনা করেছেন পনেরোটির বেশি ছবি, প্রযোজনা করেছেন কুড়িটিরও বেশি। মজার বিষয়, একবার সাবিনা ইয়াসমিনকেও তিনি অভিনয় করিয়েছিলেন নিজের সিনেমায়। সাবিনা পরে বলেন, ‘আমি তো গান করি, কোনোদিন অভিনয় করিনি। কিন্তু তিনি জোর করেই আমাকে তাঁর ছবিতে অভিনয় করালেন। সেই অভিজ্ঞতা আমার জীবনের অমূল্য স্মৃতি।’

মুক্তিযুদ্ধের সময় রেডিওতে প্রচারিত তাঁর অনেক গানের রেকর্ড ও খাতা হারিয়ে যায়। কিন্তু তাতেও থেমে থাকেননি তিনি। বয়সের শেষ প্রান্তে এসেও লিখেছেন আধ্যাত্মিক সুরের গান—যেমন ‘সবাই বলে বয়েস বাড়ে আমি বলি কমেরে’, ‘আছেন আমার মোক্তার’। তবে একসময় গান লেখার নেশায় তিনি মেডিকেলের পড়াশোনা ছেড়ে দিতে চাইলে তাঁর বাবা লিখেছিলেন-‘You are my lost game.’ কিন্তু পরবর্তীতে অসংখ্য কালজয়ী গানের স্রষ্টা হয়ে একুশে পদক অর্জন করার পর তাঁর বাবাই স্বীকার করেছিলেন-‘মানুষের পথ মানুষকেই বেছে নিতে হয়। তুই ঠিক পথেই আছিস।’

তাঁর মৃত্যুর পর তিন বছর কেটে গেছে। কিন্তু যে গানগুলো তিনি রেখে গেছেন, সেগুলো আজও প্রতিদিন বাজে বাঙালির প্রাণে। আর তাই তিনি শুধু একজন গীতিকার নন-তিনি বাঙালির হৃদয়ের গীতিকবি।

সর্বশেষ সংবাদ